প্রায় ২ বছর ধরে ইয়াবার সদর দরজা হিসেবে খ্যাত টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে অভিযানিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে টেকনাফ থানা পুলিশ। এই অভিযানে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ দৃশ্যত একচোখা নীতি অনুসরণ করে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের এই অভিযানে বারবারই ছাড় পেয়ে যায় টেকনাফ-উখিয়ার সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা। এমনকি দায়েরকৃত বেশকিছু ইয়াবার মামলার চার্জশিট থেকেও তাদের নাম বাদ দিয়ে কার্যত দায়মুক্তিও দেওয়া হয়। আর এই দায়মুক্তি দেন টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস। আর মামলার তদারক কর্মকর্তারা এর বৈধতা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া আসামিদের অনেকেই স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আবদুর রহমান বদির স্বজন, ঘনিষ্ঠ এবং ব্যবসায়িক অংশীদার। টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া বেশকিছু মামলার চার্জশিট পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ‘বিশেষ সুবিধার’ বিনিময়ে এসব আসামিদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
২০১৯ সালের ৩১ মে রাতে ইয়াবা ডন সিআইপি সাইফুল করিম কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। সাইফুল করিমকে আত্মসমপর্ণের কথা বলে মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরিয়ে আনে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। পরে পুলিশ লাইন থেকে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাসের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাকে। ওই রাতেই পুলিশ হেফাজতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সাইফুল করিম। সাইফুল করিম নিহত হওয়ার ঘটনায় টেকনাফ থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ওই মামলায় আবদুর রহমান বদির স্বজন ও ব্যবসায়িক অংশীদারসহ মোট ১৮ জনকে আসামি করা হয়।
ওই মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘সাইফুল করিমের অন্যতম সহযোগী জাফর আলম প্রকাশ টিটি জাফরের হুন্ডির মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ইয়াবার বড় চালান দেশে এনে তার অপর সহযোগীদের মাধ্যমে কৌশলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করত। জালিয়াপাড়া ঘাট এলাকায় মো. আমিন, মৌলভী মুজিব, সালমান, টিটি জাফরের ভাই গফুর, এমপি বদির ভাই শুক্কুর, শওকত, রাসেল সাইফুলের কাছ থেকে ইয়াবা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করত।’ ওই এজাহারে সাইফুল করিম বন্দুকযুদ্ধের আগে পুলিশের হাতে আটক ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। আসামিদের মধ্যে বদির ব্যবসায়িক অংশীদার টিটি জাফর, বদির আপন ভাই মো. আমিন, মৌলভী মুজিব ও শুক্কর এবং ফুফাতো ভাই রাসেল। পুলিশের নিজের করা এই বর্ণনার মধ্যে থেকে শুধু টিটি জাফর ছাড়া অন্য সবাইকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এজাহারভুক্ত আরও তিন আসামি সাবেক এমপির ছোট বোনের জামাই মো. ফারুক, ব্যবসায়িক অংশীদার মো. শফিক ও মো. কাদের। এই তিনজনকেও চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। টেকনাফের ইয়াবার শীর্ষ তালিকাভুক্ত এসব কারবারিকে তদন্তে এক প্রকার দায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র আমাদের সময়ের কাছে অভিযোগ করেছে, সাবেক এমপির এসব স্বজনদের চার্জশিট থেকে বাদ দিতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে। এসব টাকার ভাগ পেয়েছেন অনেকেই। এমনকি স্থানীয় পুলিশেরও একাধিক সূত্র এসব তদন্তে আর্থিক লেনদেনের কথা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। ওসি প্রদীপের আস্থাভাজন পুলিশ এএসআই সজিব ও এসআই সুজিত এসব আর্থিক লেনদেন করতেন।
২০১৯ সালের ১৯ মার্চ টেকনাফের লামারবাজার এলাকায় মো. ইয়াসিন আরাফাত নামে এক সন্দেহভাজন ইয়াবা কারবারি কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ ঘটনায় যথারীতি টেকনাফ থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। মামলায় ২১ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় সাবেক এমপি বদির ব্যবসায়িক অংশীদার সৈয়দ করিম ওরফে বারমাইয়া সৈয়দ করিম, সাইফুল, মো. শফিক, ওসমান এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। কিন্তু মামলার তদন্ত শেষে নাটকীয়ভাবে চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেন তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাস। সৈয়দ করিম ও শফিক শীর্ষ স্থানীয় তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। বর্তমানে টেকনাফের হুন্ডির ব্যবয়ীদের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত শফিক।
২০১৯ সালের ২ জুলাই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মেম্বার মো. হামিদ ওরফে প্রকাশ হামিদ পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় দায়ের করা মামলায় ২৪ জনকে আসামি করা হয়। এতে সাবেক এমপি বদির ব্যবসায়িক অংশীদার মো. ওসমান এবং সাবেক কাউন্সিলর ফরিদের ভাইও আসামি। এজাহারভুক্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাকে রহস্যজনকভাবে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এ ধরনের আরও বেশ কিছু মামলার নথি এবং চার্জশিটের কপি রয়েছে আমাদের সময়ের হাতে। আরও বেশ কয়েকটি মামলার এজাহার এবং চার্জশিট পর্যালোচনায় এমন চিত্র লক্ষ করা গেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে অনুষ্ঠিত ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও অতিথি হয়ে এসেছিলেন তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৬ ইয়াবা ব্যবসায়ী। এ নিয়ে তখন স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও ওসি প্রদীপের ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আমাদের সময়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
তবে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাস কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জানতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে এ বিষয়ে জানতে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইনের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনিও ফোন সিরিভ করেননি। তার মোবাইল নম্বরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর আমাদের সময়কে বলেন, ‘ইয়াবার এমন মামলায় সাধারণ নিরীহ মানুষ ফেঁসে গেলেও প্রভাবশালীরা টাকার জোরে ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়। এ কারণে ইয়াবার গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এটি দুঃখজনক। মূলত এ কারণেই কক্সবাজারে ইয়াবা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
Leave a Reply